ঘটনা-১ : মাদারীপুরে আট বছর বয়সী শিশু ফয়েস হাওলাদারকে আছাড় দিয়ে ফেলে তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে দিয়েছেন এক মাদ্রাসার শিক্ষক। ওই শিশুকে তিনি উঠে দাঁড়াতে বলেন। কিন্তু সে না দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লে শিক্ষক এ ঘটনা ঘটান বলে জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শী। ওই শিশু বর্তমানে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঘটনাটি ঘটেছে ৬ নভেম্বর।
ঘটনা-২ : পারিবারিক অশান্তির জেরে শরীয়তপুরের নরিয়ায় তিন সন্তানকে নিয়ে কীর্তিনাশা নদীতে ঝাঁপ দেন এক মা। এ ঘটনায় দুজনকে উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। বাকিদের উদ্ধারের চেষ্টা চলে। ঘটনাটি ঘটে ৫ নভেম্বর।
শিশুদের প্রতি সহিংস শাসন বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। উপরের ঘটনাগুলো এরই দৃষ্টান্ত। কিন্তু এমন অল্পকিছু ঘটনা জানা যায়। সব খবর গণমাধ্যমে আসেও না। প্রতিদিন অসংখ্য শিশু ঘরে-বাইরে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। সাধারণ মানুষ এটিকে শাসন বলে মানে। পরিবারের মা-বাবাসহ বয়সে বড়রা শিশুদের নানা কারণে চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি, এমনকি লাঠি, জুতাপেটাও করে থাকেন। কখনো কখনো এটি বিপজ্জনক পর্যায়েও চলে যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শিশুদের ওপর নির্যাতন, শারীরিক প্রহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই বিধি-নিষেধাজ্ঞার ধার ধারে না। তারা শিশুদের প্রহার ও নানা রকম শাস্তি দিয়ে থাকেÑ যা কখনো কখনো মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে শিশুর জীবন বিপন্ন করে। এ ছাড়া সুবিধাবঞ্চিত শিশু, পথশিশু, প্রতিবন্ধী শিশুরা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের মধ্য দিয়েই বেড়ে ওঠে।
জেনে নেওয়া যাক কিছু জরিপ : প্রতি দশ শিশুর মধ্যে নয়জনই তাদের অভিভাবক বা সেবা প্রদানকারীদের দ্বারা কোনো না কোনোভাবে সহিংস শাসনের শিকার হচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে ২৯২ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫৭ জনকে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। আইন ও শালিশ কেন্দ্রের (আসক) ২০২৩-এর প্রথম সাত মাসের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের অন্য এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে গত ৯ মাসে ১ হাজার ১৫৭ শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ৩১৭ শিশু। গত তিন মাসে (জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর) ১২৫ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে শূন্য থেকে ছয় বছরের ৩২, ৭ থেকে ১২ বছরের ২৬, ১৩ থেকে ১৮ বছরের ৫৩টি ও বয়স জানা যায়নি এমন ১৪ শিশু রয়েছে। এ ছাড়া গত তিন মাসে ২২৮ শিশুকে নির্যাতন করা হয়েছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) শিশু পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০২২-এর তথ্য অনুসারে এক বছরে ১২টি ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। এগুলো হলো যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, সড়ক দুর্ঘটনা, অন্য দুর্ঘটনা, অপহরণ, হত্যা, নির্যাতন, আত্মহত্যা, অপরাধে সংশ্লিষ্ট শিশু, নিখোঁজ ও পানিতে ডুবে মৃত্যু। এসব ক্ষেত্রে ২০২১ সালে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪২৬। ২০২২ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৯৪-এ। অর্থাৎ এক বছরে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর হার বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, যে কোনো ধরনের নির্যাতন শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত করে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. মেখলা সরকার বলেন, সহিংস শাসন শিশুর শারীরিক ও মানসিক- দুধরনেরই ক্ষতি করতে পারে। শারীরিক সহিংসতা বলতে আমরা যেটি বুঝি, সেটি হলো শাসনের নামে শিশুকে শারীরিকভাবে আঘাত করা। আর যেটি মানসিক সহিংসতা, সেটি হচ্ছে শিশুকে সব সময় কঠিনভাবে কথা শোনানো। তাকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করাÑ ও পারে, তুমি পারো না কেন? তার ঘাটতি নিয়ে সব সময় তাকে কটাক্ষ করা, তাকে বুলিং ইত্যাদি। এ দুটিকেই আমরা সহিংস শাসন বলে থাকি। এ দুধরনের শাসনই শিশুর বিকাশের অন্তরায়। শিশু ভুল করতে পারে, অনেক কিছুই করতে নাও পারে। সবাই তো সব পারে না। তখন শাসনের নামে তার প্রতি সহিংস আচরণ তার আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে দিতে পারে। তার মধ্যে হীনম্মন্যতা তৈরি হয়। তার সৃষ্টিশীলতা কমে যায়। নতুন কিছু করার ঝুঁকি নিতে সে দ্বিধাবোধ করে। আরেকটি বিষয় হলো, শিশুরা দেখে দেখে শেখে। যে পরিবারের মা-বাবা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া ও সহিংস আচরণ করে, ওই পরিবারের শিশুরাও সেটিই শেখে। সে তখন তার আশপাশের মানুষের সঙ্গে সহিংস আচরণ করে। তখন সে কোনো কারণে রাগ হলে সেটি প্রকাশ করতে পারে না। এর প্রভাব পড়ে তার আচরণে। এ ধরনের শিশুদের মধ্যে অ্যাংজাইটি দেখা যায়। তারা বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়। এতে তার পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যায়। পরে সে আর এই ঘাটতি পূরণ করতে পারে না। পরীক্ষার সময়ও অ্যাংজাইটির কারণে সে মনোযোগী হতে পারে না, কিছু মনে রাখতে পারে না। এটি থেকে শিশুর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে। আর শারীরিক আঘাতে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হচ্ছে, শিশুর কোথাও কেটে-ফেটে বা ভেঙে যেতে পারে। শরীরের কোনো অঙ্গের ক্ষতি হতে পারেÑ যা তাকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গুও করতে পারে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে মানসিক আঘাতটি খুব বেশি প্রভাব ফেলে।
যে কোনো ধরনের নির্যাতন শিশু অধিকারের লঙ্ঘন এবং তা শিশুর মানসিক ও শারীরিক- দুটির জন্যই ক্ষতিকর।